শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ভাবনা

Reformation of Art and Cultural Institutions

হাসান মাহমুদ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত একটি মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, কল্যাণমুখী বিশ্বমানস গঠন, দেশাত্ববোধে উদ্বুদ্ধ জাতি গঠন এবং মানুষকে উজ্জ্বীবিত করতে সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের কাক্ষিত সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি এখন সময়ের দাবী।

সংস্কৃতি ছাড়া মনোজগতের পরিবর্তন সম্ভব না। সংস্কৃতিকে জেলা উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে জনগণের কাছ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করতে যেমন রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি সংস্কৃতিকর্মীদেরকেও কিছু কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। দুষ্কৃতিকারীরা জনগণের মন ও মানসিকতায় যে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে তাকে প্রতিহত করে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক ধারায় উজ্জীবিত করার মধ্যদিয়ে সৃজনশীন মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রয়াসী হতে হবে।

ছাত্র জীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবন পর্যন্ত গত ২০ বছরে আমার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক কাজের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার আলোকে শিল্প ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ভাবনা:-

  1. সংস্কৃতির উপাদান সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, নাটক, যাত্রা, পুতুল নাট্য ইত্যাদি বিষয়কে সমসাময়িক করে তুলতে প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে সাথে আগামী দশ বছর পর এই শিল্প মাধ্যমগুলো আমাদের মনজগতে কি প্রভাব ফেলবে বা সংস্কৃতির উপাদানসমূহ বিশ্বদরবারে আমাদের ভাবমূর্তি সমুন্নত করতে কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে তা নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা প্রয়োজন।
  2. স্বায়ত্বশাসিত প্রষ্ঠানসমূহের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করা জরুরী। শিল্পীদের মনোজগতে আমলাতান্ত্রিক স্যার ম্যাডাম সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করা যাবে না। এর থেকে সংস্কৃতি বলয়কে মুক্ত করে সৃজনশীল জাতি গঠনে প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রকৃত শায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপায়িত করতে হবে।
  3. অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির সাথে সাথে অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য দক্ষ জনবল সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ের যে প্রতিষ্ঠানসমূহ রয়েছে সেখানে দক্ষ ও পর্যাপ্ত জনবলের ঘাটতি রয়েছে। সেখানে যে সরঞ্জাম রয়েছে তা পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের সীমাবদ্ধতায় অধিকাংশ সময়ে তা অকেজ অবস্থায় পড়ে থাকে। দক্ষ জনবলই পারে সংস্কৃতির জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করতে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উন্নত পরিবেশ তৈরি, মানসম্মত পরিবেশনা, কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং সরঞ্জাম সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া দরকার। পাশাপাশি এদেরকে নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমসাময়িক রাখা। প্রয়োজণে শিল্পকলা একাডেমরি আওতায় পৃথক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা।
  4. সাংস্কৃতিক ক্যাডার প্রবর্তণ করে পিএসসির মাধ্যমে উপযুক্ত দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন জনবল নিয়োগ দেওয়া। নিয়োগের ক্ষেত্রে শিল্পসংস্কৃতি কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন সাংস্কৃতিক কমীদেরকে প্রাধান্য দেওয়া। বিদ্যমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যথাযথ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়োগ বিধি সময়োপযোগী করা।
  5. জাতীয় স্মারকগুলো সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। যেমন আমাদের বধ্যভূমি, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ বা শিখা চিরন্তনের মত মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ও ঐতিহ্য বহনকারী স্থাপনাসমূহ রয়েছে। এগুলোর সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে ‘জাতীয় স্মারক সুরক্ষা কর্তৃপক্ষ’ তৈরি করতে করা। শহীদ মিনার এবং মুক্তমঞ্চসমূহে যাতে সারাবছর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যায় এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ তা বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করতে পারে তার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  6. শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চারুকলা, নাট্যকলা, নৃত্যকলা, যন্ত্রসংগীতের বিভাগ চালু করা প্রয়োজন।
  7. গোটা বিশ্ব আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেও বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলো তা থেকে পিছিয়ে। নানা ধরনের অনলাইন সেবা, অনলাইন লাইব্রেরি যেখানে মানুষ ঘরে বসে বই পড়তে পারবে, অনলাইন ডিজিটাল আর্কাইভ যেখান থেকে ঘরে বসে বিভিন্ন ধরনের আর্কাইভাল ও ঐতিহাসিক ডকুমেন্ট দেখতে বা পড়তে পারা যাবে, অনলাইনে মিলনায়তন ও মহড়াকক্ষ বরাদ্দ নেওয়া যাবে সেরকম ব্যবস্থা করা। ভার্চুয়াল প্রত্নসম্পদ প্রদর্শনী, ভার্চুয়াল চিত্রকর্ম ও আলোকচিত্র প্রদর্শনী, ভার্চুয়াল কপিরাইট কনটেন্ট আর্কাইভ, লোকসংগীত ও বিলুপ্ত প্রায় বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক উপাদান ও পরিবেশনা সংগ্রহ ও ডিজিটাল সংগ্রহশালা তৈরী করা।
  8. শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সময় উপযোগী তথ্য প্রযুক্তির অবকাঠামো নিশ্চিত করে শিল্প সংস্কৃতির কার্যক্রমকে টেকসই করার উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং দেশজুড়ে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
  9. জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ গঠনে জাদুঘরগুলোকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলা, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিকে আরো জনবান্ধব করে তোলা, অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত সাউন্ড, লাইট ও সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা রাখা এবং তার প্রাপ্তি সহজসাধ্য করে তোলা।
  10. শিশু কিশোরদের মাঝে সাংস্কৃতিক চর্চা বৃদ্ধি করতে শিশু একাডেমি এবং চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের সুবিধার্থে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ণ কর্পোরেশনকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় নিয়ে আসা। পর্যটনের সাথে সংস্কৃতির মেল বন্ধনের সুবিধার্থে পর্যটন কর্পোরেশনের সাথে যৌথভাবে কাজ করার উদ্যাগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
  11. রাষ্ট্রীয়ভাবে কেবলমাত্র বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও শিশু একাডেমিতে সংস্কৃতি বিষয়ক প্রশিক্ষনের কাজটি হয়ে থাকে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহে উপযুক্তি বেতন ভাতা দিয়ে উপযুক্ত যোগ্যতা সম্পন্ন পর্যাপ্ত সংখ্যক পূর্ণকালিন নিয়মিত শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।
  12. প্রসাশন কেন্দ্রীক শিল্পচর্চার বাইরে ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যদিয়ে মানুষের মনজগতে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে জেলা উপজেলা পর্যায়ের সংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে নাটক, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, চারুকলা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পরিবেশনা, উৎসব, প্রদর্শনী নির্মাণের জন্য আর্থিক অনুদান প্রদান করা প্রয়োজন।
  13. সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান নিয়ে গবেষণা করা, অঞ্চলভিত্তিক লোকশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবেশন, বিভিন্ন ধরনের উৎসব ও প্রদর্শনী আয়োজনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা রক্ষায় বাজেটে নিয়মিত বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।
  14. আমাদের দেশে ৫০ টি আদিবাসী বা নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের রয়েছে বর্ণিল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এরা আমাদের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও এর চর্চা বৃদ্ধি করার জন্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক কেন্ত্র বিরিশিরি (নেত্রকোণা), রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, রাজশাহী, মৌলভীবাজার, কমলগঞ্জ এই সাতটি এবং সম্প্রতি নওগাঁ, দিনাজপুর, ময়মনসিংহে নির্মিত তিনটিসহ মোট ১০টি নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানসমূহ টিকিয়ে রাখা বা বিস্তার ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। এসব প্রতিষ্ঠানে সারা বছর বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান, উৎসব, প্রশিক্ষণ, পরিবেশনা ও গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত বরাদ্দ।
  15. প্রতি বছর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সারাদেশে কয়েকশত অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ও সংগঠনকে অনুদান দিয়ে থাকে। অনুদানের টাকার পরিমান এতই সামান্য যে, তা দিয়ে খুব বেশি কিছু করা যায় না। এ অনুদানের পরিমান এবং এর আওতা যৌক্তিক হারে বাড়ানো প্রয়োজন।
  16. বাংলাদেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার সুবিধার্থে বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর যেখানে বাংলা ভাষাভাষি মানুষের বাস বেশি রয়েছে, সেখানে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সাথে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের চুক্তি মোতাবেক সাংস্কৃতিক কর্যক্রম আদান প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করা।

###

আমার সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক চর্চার শুরু স্কুলে থাকতে। নতুন প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষিয়ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনাসহ গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব পালন করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনে ২ বছর পূর্ণকালিন সংগঠন চর্চা করেছি। ২০১৮-২২ পর্যন্ত ৫ বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছি। বর্তমানে সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এবং পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি ও ইনোভেশন সেলের দায়িত্ব পালন করছি। এছাড়াও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে প্রায় সাতবছর কর্মজীবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃত থাকার সুযোগ হয়েছে।

By Hasan Mahmud

This is Hasan Mahmud from Bangladesh. I completed Masters Degree on Statistics from Jagannath University. I’m Extrovert in Nature and like to take challenge. Want to be a entrepreneur. Have involvement with Several Social and Cultural Organizations.

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *